পাগলা হাতির দ্বারা পদপিষ্ট করে দুই ভাই শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে হত্যাপূর্বক তাকে দূর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র ব্যার্থ হল।ধূর্ত কংস পরবর্তী চাল আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন।দুই শক্তিশালী কুস্তি খেলোয়াড় চানূড় আর মুষ্টিকাকে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন কুস্তিক্রীড়ায় শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে বধ করতে।

সেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ই চানূর শ্রীকৃষ্ণকে ও মুষ্ঠিক বলরামকে কুস্তিক্রীড়ার আহ্বান জানালেন।কিন্তু প্রতিযোগিতায় খেলার নিয়ম ঠিক করে দেয়া ছিল আগে থেকেও-


১) লড়াই হবে কেবল খালি হাতে,কোন অস্ত্র দ্বারা নয়
২)একজন যোদ্ধা একইসময়ে কেবল একজনের সাথেই লড়াই করতে পারবেন,একাধিকজন মিলে একজনকে আক্রমণ করা যাবেনা।
৩)যোদ্ধা একজন বালক হোক,বৃদ্ধ হোক,মধ্যবয়সী হোক,স্বাস্থ্যবান হোক বা কৃশকায়, যুদ্ধ দুইজন সমান সমান ধরনের লোকের মধ্যে হতে হবে।
৪)এক যোদ্ধাকে অপর যোদ্ধা পরাস্ত করে ভূমিতে ফেলে দিলে সে বিজ্ঞ ব্যক্তির তাকে আর কিছু করা উচিত নয়।
(হরিবংশ ২.৩০.১২,১৪)


এখানে লক্ষ্যণীয় যে ভাগবত পুরাণ অনুসারে ১১ বছর বয়সে কৃষ্ণ মথুরা ত্যাগ করেন।আবার হরিবংশে কুস্তিলড়াইয়ের নিয়মে বলা হচ্ছে সমান সমান ধরনের যোদ্ধা ই কেবল লড়াই করতে পারবে।তাহলে একজন বালক শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে শক্তিশালী কুস্তিযোদ্ধা চানূড়ের সমান?হরিবংশ লেখকের প্রশ্ন-


বালাঃ কৃষ্ণো মহানন্ধ্রঃ কথম্ ন স্যাদ্বিচারণা
কেন আমরা ভাবছি কৃষ্ণ এক বালক আর অন্ধ্রের যোদ্ধা(চানূড়) মহাবলী?
(হরিবংশ ২.৩০.১৭)

এরকম দুইজনের তো যুদ্ধ করার কথা নয়,তাহলে কেন এই লড়াই হল?এরকম প্রশ্ন সেখানেও উঠল।একজন বালক কি করে চানূড়ের সাথে লড়াই করবেন? কারণ ছিল শ্রীকৃষ্ণ স্বেচ্ছায় এই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন বালক হওয়া সত্ত্বেও।তিনি তাঁর নিজের শক্তি ও কৌশল সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত ছিলেন।তিনি বললেন-


"আমি একজন বালক,আর এই কুস্তিবিদ বলশালী পর্বতের ন্যায়,তবে আমি এই বলশালীর সাথে যুদ্ধে রাজি।আমি কদাপি লড়াইয়ের নিয়ম ভঙ্গ করবনা,খালি হাতের যোদ্ধাদের খ্যাতি আমি সমুন্নত রাখব।"

(হরিবংশ ২.৩০.১৯-২০)

কিন্তু চানূর ছিলেন অতি ধূর্ত যোদ্ধা,হরিবংশ বলছে সে অনেক যুদ্ধেই নিয়ম ভঙ্গ করে প্রতিযোগীকে হত্যা করত,শ্রীকৃষ্ণের সাথেও সে তাই করতে চলেছিল।ফলে বাধ্য হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম যথাক্রমে চানূর ও মুষ্ঠিককে বধ করলেন।

এই ঘটনা অবলোকন করে কংস ক্রোধে অধীর হলেন,শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দসহ কৃষ্ণ ও বলরামকে গ্রেফতারের আদেশ দিলেন, সকল বৃন্দাবনবাসীর সপত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়ে তিনি শীঘ্রই নন্দ,কৃষ্ণ ও বলরামকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা ঘোষণা করলেন।ভীষণ ভাষায় তিনি নন্দ ও বসুদেবকে গালাগাল করতে লাগলেন।

পিতার এহেন অপমান ও বৃন্দাবনবাসীর উপর চাপিয়ে দেয়া অত্যাচার দেখে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন।তখন তিনি এক লাফে কংসের উপবিষ্ট আসনের সামনে গেলেন এবং চুলের মুষ্ঠি ধরে কংসকে বধ করলেন।কংসের পিতামাতা মুক্ত হলেন,ধার্মিক উগ্রসেন পুনরায় রাজা হলেন,মথুরায় শান্তি ফিরে এল।

0_e7JjQmGTn5GrapmI


এখানে কিছু বক্তব্য প্রকাশ না করলেই নয়।ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী এ সময় শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল ১১ বছর।এই তথ্যটি অবশ্যই সঠিক এরকম বলা কঠিন।কেননা আগেই আমরা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে দেখেছি যে পুরাণ সমূহে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের পর হতে ৭ম-৮ম শতক পর্যন্ত  প্রচলিত লোকাচার এর ভিত্তিতে শ্রীকৃষ্ণের উপর দিব্যত্ব আরোপ করার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠে কবিদের মধ্যে।হরিবংশের Critical Edition এ BORI কর্তৃক লেখা সুদীর্ঘ ভূমিকাতেই আমরা তা দেখতে পাই।শ্রীকৃষ্ণের বয়স যত কম দেখানো সম্ভব,তাঁকে যত কৃশকায় দেখানো সম্ভব ততই তাঁর এই বিজয়কে অলৌকিক দেখানো সম্ভব।এই কারণে তাঁর বয়স ১১ ই ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়ে যায়।তবে এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে হরিবংশ সহ সবগুলো পৌরাণিক উৎসেই তখন তাকে যুবকের ন্যায় অতুল্য পেশীশক্তির অধিকারীও বলা হয়েছে।


এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হল কংসকে বধের পর তাঁরা মথুরাতেই বসবাস করছিলেন।এতদিন নন্দালয়ে শারীরিক কসরত শিখলেও সেখানে বসবাসরত অবস্থাতেই তাঁরা দুইজন প্রথম কাশীতে অবস্থিত সন্দিপনী মুনির আশ্রমে যান এবং সেখানে ধনুক ও শস্ত্রবিদ্যা লাভ করেন(হরিবংশ ২.৩৩.৪)।


মহাভারতের আদিপর্বের সম্ভব পর্বাধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই কৌরব ও পাণ্ডবরা নিজগৃহে অন্যান্য বিদ্যা লাভের পর ১৬ বছর বয়স অতিক্রান্ত হলে  অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে শস্ত্রবিদ্যা শিক্ষালাভের নিমিত্তে যান।তৎকালীন ক্ষত্রিয়দের এই ছিল নীতি।আবার শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের সমবয়সী।সেকালের সমসাময়িক ক্ষত্রিয়দের এই নিয়ম চিন্তা করলে বুঝা যায় তখন শ্রীকৃষ্ণের বয়স ১৬ অতিক্রম করেছিল,বলরামের আরও বেশী।তাই ১১ বছরের যে ভাগবত পুরাণপন্থী সেই উৎসটি তা সঠিক কিনা সন্দেহ থেকে যায় বরং পরবর্তী তথ্যটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়। 


কংসের অধ্যায় তো শেষ হল,কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের ও মথুরার যাদবদের জীবনে এই কংস মৃত্যুর পরেও অশেষ দূর্দশা নিয়ে আসল।কিভাবে? মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ ক্ষমতাশালীদের  ছেলে, মেয়ে, ছেলের বৌ, মেয়ের জামাই এদের সাথে কেউ সাধারণত হাঙ্গামা করতে যায়না,কারণ এতে অশেষ দুর্ভোগ ই প্রাপ্তি হয়।কংস ছিলেন তেমন ই এক অতি ক্ষমতাশালীর জামাতা,তিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দুই রাজবংশের একটি তথা মগধের রাজা জরাসন্ধ।কে এই জরাসন্ধ? প্রাচীন ভারতবর্ষের ১৬ টি মহাজনপদের একটি ছিল মগধ যা বর্তমান ভারতের বিহার,পাটনা,গয়াসহ তৎসংলগ্ন বিশাল অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল আর এর একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন কংসের শ্বশুর জরাসন্ধ।


অপর শক্তিশালী সাম্রাজ্যটি ছিল কুরু সাম্রাজ্য।আর মহাবীর এবং বুদ্ধ পরবর্তী সময়েও এই মগধ ছিল ভারতের চারটি বৃহত্তম শক্তির একটি।বুঝতেই পারছেন যে কোন গোষ্ঠীর শক্তি ও নিরাপত্তার মূল একটি নির্ণায়ক ছিল মগধের ও কুরুরাজ্যের সাথে তাদের সম্পর্ক।আর সেইদিকেই শ্রীকৃষ্ণ বিশাল বিপদে পড়ে গেলেন।ভোজ,বৃষ্ণি ও অন্ধকদের(যাদবদের তিনটি উপদল,শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন বৃষ্ণিদলের) সমর্থন পেয়ে উগ্রসেন আবার রাজা হলেন ঠিক ই কিন্তু-


জিঘাংসুর্হি যদুন্ক্রুদ্ধঃ কংসস্যাপচিতিম্ স্মরণ।
জামাতা কংসের মৃত্যুর কথা শুনে জিঘাংসায় ক্রোধন্মত্ত হলেন মগধের রাজা জরাসন্ধ।
(হরিবংশ ২.৩৪.৫)

কালবিলম্ব না করে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হলেন মথুরা আক্রমণ করতে।আর একা এলেন না,সাথে নিয়ে এলেন-


১)মধ্যপ্রদেশের করূশ রাজবংশের রাজা দন্তবক্র(শিশুপালের কাকাত ভাই),সাথে চেদিরাজ শিশুপাল ও কাশিরাজ কৌশল্য।উল্লেখ্য যে চেদি সাম্রাজ্যের দক্ষিণে ছোট একটি রাজ্য ছিল করূশ,করূশরা নিজেরাও যাদবদের একটি উপশাখা ছিল,কিন্তু তারা সর্বদাই ছিল চেদি সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত।মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের লাগোয়া তিনটি রাজ্য চেদি,করুশ ও কাশি,এই তিনটি মগধের পক্ষে ছিল।পরবর্তীতে আমরা দেখব কিভাবে অসামান্য কূটনীতিবিদ শ্রীকৃষ্ণ এই তিনটি রাজ্যকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষে নিয়ে এসেছিলেন।
২)কলিঙ্গের রাজা(উড়িষ্যা ও অন্ধ্র প্রদেশের অংশবিশেষ)
৩)সাথে শ্রীকৃষ্ণের ভবিষ্যৎ সহধর্মিণী রুক্মিনীর ভ্রাতা,ভিষ্মকরাজের পুত্র রুক্মী।এছাড়াও আরও বেশকিছু রাজা।
(হরিবংশ ২.৩৪.১৩-১৫)


সম্মিলিত এই বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মথুরার সীমান্তের বনমধ্যে তারা সেনাক্যাম্প স্থাপন করলেন।তারা সম্পূর্ণ মথুরাকে ঘিরে ফেলল।
(হরিবংশ ২.৩৫.১,২৫)
এতবেশী তাঁবু হয়েছিল যেন মনে হচ্ছিল শ্বেতসমুদ্র।পরদিন সকালে যুদ্ধ শুরু হল।

যাদবরা সংখ্যায় কম হলেও অতি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করল(হরিবংশ ২.৩৫.৫৩)


প্রচণ্ড যুদ্ধ হতে লাগল,বলরাম ও জরাসন্ধের মধ্যে গদাযুদ্ধও হল,কেউ কাউকে হারাতে পারলেন না।দুইজন ই আহত হলেন একে অপরের হাতে।যাদবদের সংখ্যা কম হওয়ায় ধীরে ধীরে তাদেরকে আতংক গ্রাস করতে থাকল।

সৃজন্তঃ শরবর্ষাণি সম্ভিত্যাক্তজীবিতঃ
(২.৩৫.১০৫)

জীবনের আশা ক্ষীণ দেখে যাদবরা প্রাণপণে শরবর্ষণ করতে লাগল।


এভাবে ৮ দিন ব্যাপী যুদ্ধ চলল।যাদবরা সংখ্যায় কম হলেও প্রাণপণে যুদ্ধ করে প্রবল পরাক্রম দেখাল এবং এইবারের মত জরাসন্ধকে আঁটকে দিতে সমর্থ হলে।এই যাত্রায় বেঁচে গেল মথুরা।

কিন্তু যাদবরা জানতেন-
জরাসন্ধম্ তু তে জিত্ব মেনিরে নৈব নির্জীতম্
জরাসন্ধকে এবার কোনরকমে আঁটকানো গেছে,কিন্তু এভাবে কতদিন?


একের পর এক-
দশশ্চষ্টতৌ চ সংগ্রামঞ্জরাসন্ধস্য যাদবঃ
১৮ বার এভাবে জরাসন্ধ ও যাদবদের মধ্যে যুদ্ধ হল।


অল্পত্বদভিভুতস্তু বৃষ্ণয়ো ভারতর্ষভ।
বর্হদ্রথেন রাজেন্দ্র রাজভিঃ সহিতেন বৈ।।
(হরিবংশ ২.৩৬.৩৯)

এভাবে যুদ্ধ করতে করতে তুলনামূলক কম শক্তির অধিকারী যাদবরা ক্লান্ত,দূর্বল হয়ে পড়ল।


তারা একপর্যায়ে বুঝতে পারলেন-
বহুলপি চ সৈন্যানি হন্তুম বর্ষ শতৈরপি
(হরিবংশ ২.৫৫.৯৯)

জরাসন্ধের সৈন্যসংখ্যা এতই বৃহৎ যে তাদের ১০০ বছরেও পরাজিত করা সম্ভব নয়-

তাই-
ব্রভিমি মথুরম্ পুরীম্ বসতোরাভয়োঃ শ্রেয় ন ভবেদিতি।
এই মথুরায় আমাদের আর থাকা নিরাপদ হবেনা।


মহাভারতেও পরবর্তীকালে পাণ্ডবদের সাথে কথোপকথনে শ্রীকৃষ্ণ একই কথা বলেছিলেন-

ন হন্যামো বয়ং তস্য ত্রিভির্বর্ষশতৈর্বলম্॥ 
(মহাভারত২.১৪.৩৮)

অনুবাদ-আমরা যাদবরা তিনশ বছর যুদ্ধ করলেও অজেয় জরাসন্ধকে হারাতে পারবনা।


অষ্টাদশ ময়া তস্য সঙ্গ্রামা রোমহর্ষণাঃ।
(মহাভারত,২.১৪.৪২)

অনুবাদ-জরাসন্ধ আমাদের ১৮ বার ভীষণ আক্রমণ করেন,আমরা অনেক সংগ্রাম করে বেঁচে ছিলাম।


পলায়ামো ভয়াত্তস্য সসুতজ্ঞাতিবান্ধবাঃ।
ইতি সঞ্চিন্ত্য সর্বে স্ম প্রতীচীং দিশমাশ্রিতাঃ॥
(মহাভারত ২.১৪.৫২)

অনুবাদ-টিকে থাকা অসম্ভব দেখে দিশেহারা হয়ে আমরা ভয়ে পালিয়ে গেলাম।


কুশস্থলীং পুরীং রম্যাং রৈবতেনোপশোভিতাম্।
ততো নিবেশং তস্যাং চ কৃতবন্তো বয়ং নৃপ॥
(মহাভারত ২.১৪.৫৩)

অনুবাদ-পালিয়ে আমরা রৈবতক পর্বত দিয়ে ঘেরা কুশস্থলীতে আশ্রয় নিলাম এবং প্রাচীন দূর্গসমূহ সংস্কার করে সেখানেই বসতি স্থাপন করলাম।

আর এই কুশস্থলী ই বর্তমান গুজরাটের দ্বারকা।তিনদিকে পর্বতশ্রেণী আর একপাশে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা,ভৌগলিকভাবে সবচেয়ে নিরাপদ এমন একটি স্থান ই যাদবদের নতুন রাজ্য নির্মাণের জন্য বেছে নিলেন তিনি।নিজেদের জন্মস্থান মথুরা ছেড়ে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দূরের দ্বারকায় এসে বসতি গড়লেন নতুন জীবনের আশায়।মধ্য প্রদেশের কৃষ্ণ এখন হলেন গুজরাটের অধিবাসী,অবশ্য পুরো ভারতবর্ষের ই প্রাণ যিনি তাঁর মথুরাই কি, গুজরাট ই বা কি।


হরিবংশের বিষ্ণুপর্বের ৫৮ নং অধ্যায়ের পুরোটিই নতুন দ্বারকা নগরী নির্মাণের বর্ণনা।কামার,কুমোর,রাজমিস্ত্রী সহ সকল যাদবরা দিনরাত পরিশ্রম করতে লাগলেন নতুন নগরী প্রতিষ্ঠার জন্য। শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন রাজ্যের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলীদের নিয়ে আসার জন্য দূত প্রেরণ করলেন নগর নির্মাণার্থে-

প্রেশ্যন্তম  শিল্পীমূখ্যাণাম্  যুক্তাণাম্ বেশমকর্মসু।

(হরিবংশ ২.৫৮.১০)

যাও,তোমরা শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলীদের খবর দিয়ে নিয়ে এসো নগর নির্মাণের জন্য। 


কেমন ছিল সেই দ্বারকা নগরী? শ্রীকৃষ্ণের ভাষায়-

ত্রিয়োজনায়তং সদ্ম ত্রিস্কন্ধং যোজনাবধি॥ 

(মহাভারত সভাপর্ব ২.১৪.৫৭)

অর্থাৎ রৈবতক পর্বতমালা প্রায় ৩৯ কি.মি দীর্ঘ,১৩ কি.মি. প্রশস্ত।

dwaraka-ji-old



যোজনান্তে শতদ্বারং বীরবিক্রমতোরণম্।

অষ্টাদশাবরৈর্নদ্ধং ক্ষত্রিয়ৈর্যুদ্ধদুর্মদৈঃ॥ 

অষ্টাদশ সহস্রাণি ভ্রাতৃণাং সন্তি নঃ কলে।


(মহাভারত, ২.১৪.৫৮,৫৯)


নগরে ঢুকতে মোট ১০০ টি প্রবেশপথ রাখা হল এবং প্রতিটি দ্বারে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হল।১৮০০০ শক্তিশালী ক্ষত্রিয়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা হল সেনাবাহিনী।আর এই অসংখ্য প্রবেশ দ্বারের কারনেই এর নাম হয়েছিল দ্বারকা বা দ্বারের নগরী।মূল ফটক ছিল চারটি।


হরিবংশ ২.৫৮.১০ এ আমরা দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণ নির্মাণশিল্পীদের বলছেন নগরীতে পর্যাপ্ত ঘর,প্রাসাদ,হাইওয়ে রোড এসবের ব্যাবস্থা রাখতে।২.৫৮.৩৩ এ আমরা দেখতে পাই পানি নিষ্কাশন ব্যাবস্থা রাখার কথা বলছেন শ্রীকৃষ্ণ। 


চারুদেষ্ণঃ সহ ভ্রাত্রা চক্রদেবোঽথ সাত্যকিঃ।

অহং চ রোহিণেয়শ্চ সাম্বঃ প্রদ্যুম্ন এব চ॥

(মহাভারত ২.১৪.৬০)

তিনি,তাঁর ভাই বলরাম, সাত্যকি,শাম্ব,চারুদেষ্ণ,চক্রদেব,চক্রদেবের ভাই এই ৭ জন মিলে রইলেন সেনাবাহিনীর প্রধান দায়িত্বে।


হরিবংশ ২.৫৬.২৯ এ এও বলা হয়েছে দ্বারা বা দাবার বোর্ড এর মত চারকোণা আয়তনের ছিল বলে এর নাম ছিল দ্বারাবতী যা পরবর্তীতে দ্বারকা নামে প্রসিদ্ধ হয়।আপনারা নিশ্চয় জানেন দাবা খেলা তথা চতুরঙ্গের উৎপত্তি কিন্তু ভারতবর্ষেই!


হরিবংশ ২.৫৮.১৮ তেও দ্বারকা নগরীকে দূর্ভেদ্য করতে শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে শহরের চারপাশে তৈরীকৃত দেয়ালের দূর্গের কথা বলা হয়েছে।


পরবর্তীতে কালের আবর্তে শ্রীকৃষ্ণের তিরোধানের পর  এই নগরীটি সাগরের নিচে বিলীন হয়ে যায় যা মহাভারতের মৌষল পর্বে স্পষ্ট উল্লেখিত রয়েছে।


দ্বারকাং রত্নসংপূর্ণাং জলেনাপ্লাবয়ত্তদা॥

(মৌসলপর্ব, ১৫.৮.৪২)

অতঃপর রত্নসম্ভার সমৃদ্ধ দ্বারকা নগরী সমুদ্রের জলের নিচে মিলিয়ে গেল।


মজার বিষয় হল দ্বারকা নগরীতে যেন কোন শত্রু ঢুকে পরতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা ছিল আইডি কার্ডেরও!১৯৮৩ সালে ভারতের National Institute of Oceanography এর তত্ত্বাবধানে গুজরাটের যে স্থানে মহাভারতের দ্বারকা অবস্থিত ছিল সেই স্থানে কচ্ছ উপসাগরের নিচে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালান আর খুঁজে পান অসম্ভব সমৃদ্ধ সভ্যতাবিশিষ্ট ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বের শ্রীকৃষ্ণের সেই দ্বারকা নগরী যা অনেক অবিশ্বাসীরা এতদিন শুধুই গল্প বলে মনে করে আসছিল।আর সেই অনুসন্ধানে পাওয়া যায় তিন প্রাণীর মাথা খোদাই কটা বিশেষ একধরনের মুদ্রা যা একমাত্র দ্বারকার নাগরিকদেরকেই দেয়া হত,শহরের যে কোন দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে হলে সেই মুদ্রাটি আইডি কার্ড হিসেবে দ্বাররক্ষকদের দেখাতে হত,কেবল তাতেই মিলত নগরীতে প্রবেশের অনুমতি।আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর পূর্বেই মহান এই রাজনীতিবিদ কত আধুনিক ব্যবস্থা নির্মান করেছিলেন রাজ্য রক্ষায়।আজকের হিন্দুরা তাঁর ভক্ত হবার নাম করে নাচ,গান আর প্রসাদ ভোজনের নামে উদরপূর্তি ও স্বস্তা বিনোদনের নেশায় মত্ত।সেই মহান প্রজ্ঞাবান,দূর্ধর্ষ যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ,শ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক রাজন্য,বীরদের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি কি?


শ্রীকৃষ্ণের অসামান্য রাজনৈতিক মেধার বর্ণনায় যুধিষ্ঠির বলেছিলেন-


অন্ধং বলং জডং প্রাহুঃ প্রণেতব্যং বিচক্ষণৈঃ॥

যতো হি নিম্নং ভবতি নয়ন্তি হি ততো জলম্।

যতশ্ছিদ্রং ততশ্চাপি নয়ন্তে ধীবরা জলম্॥

তস্মান্নয়বিধানজ্ঞং পুরুষং লোকবিশ্রুতম্।

বয়মাশ্রিত্য গোবিন্দং যতামঃ কার্যসিদ্ধয়ে॥

এবং প্রজ্ঞানয়বলং ক্রিয়োপায়সমন্বিতম্।

(মহাভারত ২.২০.১৬-২০)


অনুবাদ-প্রাজ্ঞ নেতা ছাড়া সৈন্যদল যেকোন কিছুর মতই অধম।এমনকি জেলেও মাছ ধরতে গেলে ছিদ্র দিয়ে জল উঠতে পারে কিনা তা খেয়াল করে(অর্থাৎ বুদ্ধিমান নেতা নিজের শক্তি ও শত্রুপক্ষের দূর্বলতা বুঝেই কাজ করে),আর এই বুদ্ধিমত্তার জন্যেই শ্রীকৃষ্ণের রাজন্যপ্রজ্ঞার খ্যাতি সারা বিশ্বের মুখে মুখে।তাই যদি কোন কার্যে সফল হতে চাও তবে শুধু গোবিন্দকে নেতা বানিয়ে তাঁর প্রজ্ঞা ও কর্মের অনুসরণ কর,তবেই দেখবে সাফল্য নিশ্চিত!


ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি