VedasBD.com

" ন তস্য প্রতিমা অস্তি" নিয়ে ভ্রান্তি নিবারণ ও অপপ্রচারের জবাব


অতীতে কিছু সময় ছিল যখন সাধারণ হিন্দুদের কাছে তাদের শাস্ত্র ছিল অস্পৃশ্য। এছাড়াও শুদ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যেদের যদিওবা বেদ শোনার অধিকার ছিল, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় শূদ্ররা বেদ শুনলে তার কানে গরম সীসা ঢেলে দেওয়ার কুসংস্কার তথা কুপ্রথা প্রচলিত ছিল ।  পুরাণ ও বেদ বিরুদ্ধ মানব দ্বারা রচিত স্মৃতির এমনই কুসংস্কার মূলক আইন ছিল। এছাড়াও নানা কুসংস্কার, কুপ্রথায় ছিল জর্জরিত এই অভাগা হিন্দু সমাজ। এইসব কুপ্রথা, ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যেসব মহাত্মারা লড়াই করেছেন তাদের মধ্যে রাজা রাম মোহন রায় ও মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। বেদ ও বশাস্ত্র বিরুদ্ধ এসব অন্যায় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁরা অফুরন্ত আঘাত হেনেছিল বেদ, উপনিষদ ও অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থের আলোকে। উল্লেখ্য এই দুইজন ব্যক্তির মহত্ব কর্মে আমরা বেশ কিছু সাদৃশ্য দেখতে পাই। তাঁরা যেমন ছিলেন কুসংস্কারের বিরোধী, তেমনি তাঁরা অভাগা হিন্দুদের কুসংস্কার ও কুপ্রথা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে খুঁজে নিয়েছিলেন বেদ উপনিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈদিক শাস্ত্র। তাঁদের উভয়ের মতেই আমাদের অধঃপতনের অন্যতম কারণ আমরা বৈদিক এক ঈশ্বরের উপাসনা ত্যাগ করে বহু মতে, বহু পথে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। তাই তাঁরা জোর দিয়েছিলেন আমরা যেন সেই বৈদিক এক ঈশ্বরের উপাসনার পথে কঠোর পরিশ্রম দ্বারা অগ্রসর হই। এই দুই মহাপুরুষই বেদ উপনিষদে বর্ণিত নিরাকার এক ব্রহ্মের উপাসনার কথা বলেছেন। এই বিষয়ে একটি মজার ঘটনা না বললেই নয়। রাজা রামমোহন রায় যখন বাংলায় ঈশ, কেন, কঠ উপনিষদ অনুবাদ করে নিরাকার ব্রহ্মবাদের প্রচার শুরু করলেন এক দল তথাকথিত পণ্ডিত প্রচার করা শুরু করে যে, উপনিষদ বলে সংস্কৃতে কোনো শাস্ত্রই নেই, ঈশ, কেন, কঠ প্রভৃতি নাকি তিনি রচনা করেছেন। এই অভিযোগ এত মানুষ বিশ্বাস করেছিল যে তিনি প্রকাশ্যে এসে  বলেছিলেন যে, “এই কলিকাতা শহরে শ্রীযুক্ত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বাড়িতে গেলেই দেখতে পাবেন যে, বেদান্ত শাস্ত্রের সকল পুঁথি তাঁর ঘরে সংগ্রহীত রয়েছে।”  মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ছিলেন রামমোহন রায়ের বিপক্ষ দলের অগ্রগণ্য পণ্ডিত। এই ধরণের মূর্খ পণ্ডিত সর্বকালেই দেখা যায়। যে মহর্ষি বেদ মন্ত্র থেকে প্রমাণ বের করে দেখালেন বেদ কেবল ব্রাহ্মণ নয়, স্ত্রী-শুদ্র সকলেই পড়তে ও অধ্যায়ন করতে পারবে; সেই মহর্ষিকেই আজকাল কতিপয় ভন্ড ধর্মব্যবসায়ীগণ
বলেন যে তিনি নাকি ভুলভাবে বেদ ব্যাখ্যা করেছেন। আজ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বেঁচে থাকলে বুঝতেন এই হিন্দু জাতির বেদ অধিকার দিতে চেয়ে তিনি কত ভুল করেছেন।আজকাল কিছু সেরকম ভন্ড ধর্মব্যবসায়ী গণ ব্যক্তি দাবি করেন যে বেদ তথা বৈদিক ঈশ্বর নিরাকার না, মহর্ষি দয়ানন্দ ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেখানে অরবিন্দের মত যোগী বলেছেন যে, মহর্ষি দয়ানন্দই বেদের প্রকৃত তাৎপর্য, প্রকৃত অর্থ তুলে ধরেছেন সেখানে ভন্ড পণ্ডিতদের মিথ্যা প্রলেপন বাতুলতা ভিন্ন কিছুই না। তাদের দাবি যজুর্বেদের ৩২তম অধ্যায়ের ৩য় মন্ত্র নাকি প্রতিমা পূজার নিষেধ করছে না। তবে চলুন দেখি কি বলছে যজুর্বেদ ৩২/৩-মহর্ষির ভাষ্যে বলা রয়েছে–
.
ন তস্য প্রতিমা অস্তি য়স্য নাম মহদ্ য়শঃ।
হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষা য়স্মান্ন জাত
ইত্যেষঃ।।

অনুবাদ: যাঁর মহান প্রসিদ্ধ যশ রয়েছে সেই পরমাত্মার কোনো রকম প্রতিমা নেই। "হিরণ্যগর্ভ" আদি মন্ত্রে, "মা মা হিংসীত্" এই মন্ত্রে ও "য়স্মান্ন জাত" এই মন্ত্রে সেই পরমাত্মার বর্ণন রয়েছে।
মহর্ষির ভাষ্য “ন নিষেধে তস্য পরমেশ্বরস্য প্রতিমা প্রতিমীয়তে য়য়া তৎপরিমাপকং সদৃশং তোলনসাধকং প্রকৃতিরাকৃতিরবা অস্তি বর্ততে” অর্থাৎ সেই পরমেশ্বরের তুল্য পরিমাণ সদৃশ সাধক প্রতিকৃতি বা মূর্তি কিছুই নেই।
.
সম্প্রদায়বাদী সেই গোঁড়াদের দাবি এই মন্ত্রে প্রতিমা
শব্দ দ্বারা নাকি মূর্তিকে বোঝায় নি, কেবল উপমা বা
তুলনা অর্থে বুঝিয়েছে। তাদের দাবি পুরাতন
ভাষ্যকাররা নাকি এমন কোনো অর্থ করে যাননি, মহর্ষি
দয়ানন্দই কেবল এই অর্থ করেছেন।
বেশ দেখুন তাদের আদরণীয় উবট ও মহিধর কি ভাষ্য
করেছে, যজুর্বেদ ৩২।৩,  মহিধর ভাষ্য সহিত ভাষ্য করা হয়েছে–
"ন তস্য পুরুষস্য প্রতিমা প্রতিমানভূতং
কিঞ্চিদ্বিদ্যতে" 
"তস্য পুরুষস্য প্রতিমা প্রতিমানমুপমানং কিঞ্চিদ্বস্তু
নাস্তি"।।

অর্থাৎ সেই পুরুষের প্রতিমা, তুলনা বা উপমা কিছুই নেই। উভয়েই বলছেন প্রতিমা নেই। এই মন্ত্র দ্বারা যেমন প্রমাণ হয় ঈশ্বরের তুল্য কিছু নেই, তেমনি তাঁর প্রতিমা বা মূর্তি নেই।
.
 প্রতিমা অর্থ যে মূর্তি হয় তা মানতে নারাজ পণ্ডিতম্মন্যরা। মূর্তি শব্দ অবৈদিক দেখে বেদে মূর্তি শব্দ নেই, সে স্থলে আছে প্রতিমা। প্রতিমা অর্থ যে মূর্তি তা বৈদিক কোষেও উল্লেখিত আছে–

দেখা যায় প্রতিমা=উপমা দেখাতে তারা সাধারণ বাংলা অভিধান ইউজ করে৷ অথচ একটি বিখ্যাত প্রাচীন অভিধান অমরকোষ এ প্রতিমার ৮ প্রতিশব্দ আছে যা মূর্তি নির্দেশ করে দেখুন–
.
প্রতিমানং প্রতিবিম্বং প্রতিমা প্রতিয়াতনা
প্রতিচ্ছায়া।
প্রতিকৃতিরর্চা পুংসি প্রতিনিধিরুপমোপমানং স্যাত্।।
(অমরকোষ ২।১০।৩৫)

যারা বলে পরমাত্মার উপমা নেই তারাই বরং ভুল বলে। কারণ পুরুষসূক্তসহ বেদের অসংখ্যস্থলে পরমাত্মার মহিমাকে বিভিন্ন উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা হয়েছে৷ সামবেদের ৪৩ নং মন্ত্রটি দেখুন -
.
আ নো অগ্নে বয়োবৃধং রয়িং পাবক শংস্যম্।
রাস্বা চ ন উপমাতে পুরুস্পৃহং সুনীতী মুযশস্তরম্ ॥
[সামবেদ - ৪৩]

পদার্থঃ হে (পাবক) চিত্তশোধক, পতিতপাবন (অগ্নে)
সম্মুখ মার্গ প্রদর্শক পরমাত্মা ! তুমি (বয়োবৃধম্) আয়ুকে বর্ধনকারী, (শংস্যম্) প্রশংসাযোগ্য (রয়িম্) ধনকে (নঃ) আমাদের জন্য (আ) নিয়ে এসো। হে (উপমাতে) উপমানভূত ,সর্বোপমাযোগ্য পরমাত্মা ! (পুরুস্পৃহম্) অধিক আকাঙ্ক্ষিত অথবা বহু লোক দ্বারা আকাঙ্ক্ষিত, (সুয়শস্তরম্) অতিশয় কীর্তিজনক সেই ধনকে (সুনীতী) সন্মুখ মার্গে চালিত করে (নঃ) আমাদের (রাস্ব চ) প্রদানও করো।
.
অনুবাদ– হে চিত্তশোধক পতিতপাবন সম্মুখ মার্গ প্রদর্শশক  পরমাত্মা  তুমি আয়ুুর বর্ধনকারী,  প্রশংসা  যোগ্য ধনকে আমাদের জন্য নিয়ে এসো। হে উপমানভূত ,সর্বোপমাযোগ্য পরমাত্মা ! অধিক আকাঙ্ক্ষিত অথবা বহু লোক দ্বারা আকাঙ্ক্ষিত,  অতিশয় কীর্তিজনক সেই ধনকে সন্মুখ মার্গে চালিত করে আমাদের প্রদানও করো।
.
চলুন বৈদিক ঈশ্বরের সাকার নিরাকার কি আকার সে
নিয়ে বেদ ও উপনিষদ কি বলে তা দেখে নিই:–
যজুর্বেদ ৪০।৮ বলছে ঈশ্বর অকায়ম(সর্বপ্রকার শরীররহিত)
.
মহর্ষি দয়ানন্দ স্বরস্বতীর ভাষ্যে বলা হয়েছে–

আচার্য শঙ্কর ভাষ্য তিনিও একই অর্থ করেছেন সেই আত্মা। (পরমাত্মা) স্থুল, সূক্ষ্ম শরীর বিবর্জিত
(ঈশ উপনিষদ ৮, শঙ্কর ভাষ্য)

এবার তাহলে প্রশ্ন রইল, যার কোনো শরীরই নেই তাঁর
মূর্তি বা প্রতিমা আপনারা কিভাবে তৈরি করবেন?

কঠ উপনিষদ ১।২।২২ তে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রহ্ম প্রাণীগণের শরীরে থেকেও শরীর রহিত–

কঠ উপনিষদ ১।৩।১৫ তে উল্লেখ করা রয়েছে, পরমাত্মা অরূপম বা রূপহীন, কেবল সেই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে
পারলেই মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে–

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩।১০ একই ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।–

 তৈত্তিরীয় উপনিষদের ব্রহ্মানন্দবল্লীর সপ্তম অনুবাকেও বলা হয়েছে –

মুণ্ডক উপনিষদ ২।১।২ তে বলা হয়েছে সেই দিব্য পুরুষ
অমূর্ত বা মূর্তিহীন–

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬।৯ উল্লেখ রয়েছে সেই ঈশ্বরের কোনও চিহ্নবিশেষও নেই–

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট বেদ উপনিষদের সর্বত্রই নিরাকার মূর্তিহীন ঈশ্বরের কথা বলছে। বেদের কোথাও যেখানে পরমাত্মার মূর্তি বা প্রতিমা উপাসনার নামগন্ধ নেই, সেখানে ধর্ম ব্যবসায়ীরা বেদ মন্ত্র বিকৃতির আশ্রয় নিয়ে প্রতিমা পূজা প্রচলিত করে থাকে ও তা প্রচার করে বেড়ায়। বৈদিক ধর্মে পৌত্তলিকতার কোনো স্থান নেই। আর বৈদিক ধর্ম কেবল এক পরমাত্মার উপাসনার কথাই বলে। যারা জড় মূর্তি পূজা করে ভাবছেন ঈশ্বরের উপাসনা করছেন তারা কেন উপনিষদের এই শ্লোক টি দেখুন- (কেন উপনিষদ ১।৬)

য়চ্চক্ষুষা ন পশ্যতি য়েন চক্ষুংষি পশ্যতি।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে।।

অনুবাদ: চোখ দিয়ে যাঁকে দেখা যায় না, কিন্তু লোকে দৃশ্যমান বিষয়গুলো যাঁর দ্বারা দেখে থাকে, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে যেন। লোকে যেসব দৃশ্যমান বস্তুর উপাসনা করে তা ব্রহ্ম নয়।
.
তাহলে আপনারাই চিন্তা করে দেখুন  মূর্তির সামনে
কুসংস্কার কে সমর্থন করে প্রকৃতপক্ষে কার উপাসনা করছেন? তা মোটেও ব্রহ্মোপাসনা নয়। তাই আমাদের সকল বৈদিক মতাদর্শীর উচিত সকল প্রকার মূর্তিপূজা তথা পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে শুধুমাত্র এক সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের উপাসনা করা। তবেই আমাদের যথার্থ মঙ্গল হবে।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

NO COMMENTS:

POST A COMMENT